যুগইল্যার গাছের জাম্বুরা ক্যাডা খাইসে?

অনিমেষ বৈশ্য

কাকু, আপনাদের গ্রামে কি মেঘ করেছে আজ?
আমি বলি, হ্যাঁ মেঘ করেছে ।
সে বলে, ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে?
আমি বলি, হ্যাঁ, বইছে তো।
সে বলে, দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে দিশাহারা হয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক?
আমি বলি, হ্যাঁ, ওই তো ভোর থেকে ডাকছিল যে দোয়েল পাখিটা, ঘন মেঘ দেখে সে পাতার আড়ালে গুটিসুটি মেরে আছে।
সে বলে, যখন বৃষ্টি আসবে, আমাকে জানাবেন।
আমি বলি, তুইও জানাস।

দুজনেই ফোন রেখে দিই। অথবা শেষ হয় মেসেঞ্জারে বাক্যালাপ। কখন বৃষ্টি নামল আর জানানো হয় না। আমি ঠিক জানি, সে-ও ঠিক জানে, আমাদের দুজনের উঠোনে একই সময়ে আছড়ে পড়েছিল বৃষ্টিধারা। একই সময়ে দুটো নেড়ি কুকুর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দৌড়ে উঠে পড়েছিল আমাদের আর ওদের বারান্দায়। একই সময়ে মাটি আর বৃষ্টির গন্ধে ভুরভুর করছিল দিগ্বিদিক। অথচ আমি আর বছর পঁচিশের যুবক রানা হেনা আলাদা দেশে থাকি। সে ও-পারে, আমি এ-পারে।
সত্যিই কি আলাদা দেশ? নাকি আলাদা পাড়া? ছোটবেলায় হ্যারিকেনের আলোয় দুলে দুলে পড়েছি রবি ঠাকুরের কবিতা, ‘দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি/ মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক/তাদের বনের অনেক মধুমাছি/ মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক…’ । যখন পড়ছি, তখন হ্যারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে আমার ঠাকুরদা বিছানায় শুয়ে কীর্তনের সুর ভাঁজছিলেন। আচমকা গান থামিয়ে দিয়ে বললেন, ”আর একবার পড়ো দেহি, যেইডা পড়লা এই মাত্র।’ আমি পড়ি, তাদের বনের অনেক মধুমাছি/ মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক… আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা/ আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা…।

আঁধারে ঠাহর হয় না ঠাকুরদার চোখে জল চিকচিক করছে কি না। তিনি শুধু বলেন, ‘আমাগো গ্রামের নাম আছিল কদমা। আমাগো নদীর নাম চিলাই।’ তার পর মৌমাছির মতো অজস্র ধুলোবালি ঠাকুরদার ছেঁড়া চাদরের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে অবিরাম। ঠাকুরদা হাঁটতে থাকেন চিলাই নদীর পাড় ধরে। খালি পায়ে ধুলো লাগে। ফাটা গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে বয়ে যায় নদীর হাওয়া। ধানক্ষেতে ঝড় ওঠে। ঠাকুরদা ধানক্ষেতের আলপথ ধরে কতদূর হেঁটে যাবেন কে জানে। তিনি হাঁটেন আজ কাল পরশু।
আমার ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে ছিলেন, মনে মনে বাংলাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল-আমের বন দিয়ে হেঁটেছেন। তা বলে বসে থাকেননি। বসে থাকার উপায়ও ছিল না। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষের পায়ের নীচ মোটেই মসৃণ হয় না। অজস্র ফাটা দাগ। অজস্র ধুলো। অজস্র কাঁটা বেঁধার যন্ত্রণা পায়ের নীচে বিঁধে থাকে।
একটা বড় দেওয়াল ঘড়ি। আর একটা কাঠের আলমারি। এই দুটো জিনিস দ্যাশের বাড়ি থেকে আনতে পেরেছিলেন ঠাকুরদা। একই ঘড়ি। শুধু কবে যেন আধ ঘন্টার তফাত হয়ে গেল। যারা এই তফাত গড়ে দিল, যাদের জন্য ফেলে আসতে হল নেড়ি কুকুর, গাই-বাছুর, উঠোনের বকুলগাছ তাদের কোনও দিনই ক্ষমা করতে পারেনি তিনি। শুধু তিনি কেন, কেউই পারেননি।

আমাদের ছিল বাঙাল পাড়া। ও-পারে যাঁরা পাশাপাশি থাকতেন, এ-পারেও তাঁরা পাশাপাশি থাকতে শুরু করেন। হয়তো ভয়ে। হয়তো চেনা শ্বাসপ্ৰশ্বাসের লোভে। দেশ ছেড়ে এসে অবিকল আর একটা দেশ গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল সকলেরই। উঠোনে মাটির উনুন। মড়া খেজুর গাছ দিয়ে পুকুরের ঘাট। পুকুরে দলবদ্ধ পুঁটিমাছ। মাটির উনুনে ধানসেদ্ধ করা, তার পর লাল চালের জাউভাত…বাংলাদেশকে ধরে রাখার কোনও চেষ্টাই বাকি ছিল না। সকাল থেকে বাঙাল কলকাকলিতে জেগে উঠত পাড়া। যার নাম যুগল, তাকে সবাই ডাকে যুগইল্যা, মানিককে মাইনকা, নীলুকে নিল্যা। ঝগড়াঝাঁটিও কম ছিল না। পাড়ার পুজোর মিটিং বসেছে। ছেলে-বুড়ো-মদ্দ-জওয়ান সবাই হাজির। হঠাৎ কে একজন বলে উঠল, ‘যুগইল্যার গাছের জাম্বুরা ক্যাডা চুরি করছে, আগে হেইয়ার সালিশি হোক। মিটিং হইব পড়ে।’ যুগইল্যার বাবা এ-দেশে এসে বাগানে পুঁতেছিলেন একটা বাতাবি লেবুর গাছ। কিন্তু বাতাবিলেবু কেউ বলত না। সবাই বলত জাম্বুরা। কোনও ফচকে ছোঁড়া খান কতক জাম্বুরা চুরি করায় ভারি রাগ যুগইল্যার। কোন ডালে কটা জাম্বুরা, সব হিসেব থাকত। প্রায়ই সকালে রামদা হাতে যুগইল্যার আস্ফালন শুনতাম, ‘জাম্বুরা চোররে যদি ধরতাম পারি তাইলে কাইড্ডা হালামু। আবাগির বেডা।’ এ বাড়ির লিটন, ও-বাড়ির ধনা, ,সে-বাড়ির পটলা থলে হাতে লাইন দিত রেশন দোকানে। পোকায় কাটা চাল, লাল গমের আটা…উদ্বাস্তুর কি অত বাছবিচার চলে? আখের গুড় দিয়ে রুটি খেয়ে এ-বাড়ির রমা, সে-বাড়ির আশালতা সন্ধ্যায় ভাঙা হারমনিয়ামে সুর তুলত, খরবায়ু বয় বেগে চারিদিক ছায় মেঘে…।

আমার ঠাকুরদা আর একটা জিনিস দ্যাশ থেকে এনেছিলেন—কাঠের ছাতা। ছাতা মাথায় তিনি দেশ ছেড়ে আসছেন। হেঁটে আসছেন মাঠঘাট দিয়ে। কাঁধে পোঁটলা, পিছনে স্ত্রী, সন্তানাদি, পোষ্য কুকুর। ফেলে আসা জন্মভূমির রোদ লাগছে ছাতার গায়ে, ফেলে আসা দেশের হু হু হাওয়ায় বেঁকে যাচ্ছে ছাতার শিক। ওই ছাতাই তখন দ্যাশের মাটির বাড়ি, ওই ছাতাই মাটির বারান্দা, ওই ছাতাই তখন পদ্মা-মেঘনার কূল ছাপানো ঢেউ। আমার ঠাকুরদা কৃতী ছাত্র ছিলেন। এ-পারে এসে অতি কষ্টে একটি প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারির চাকরি পেয়েছিলেন। বাড়ি থেকে সাত-আট মাইল দূরে সেই স্কুল। হেঁটে যেতেন। হেঁটে আসতেন। মাথায় থাকত সেই কাঠের ছাতা। বাড়িতে ফিরে ছেলেদের পড়াতেন। নিজেও পড়তেন। টিনের চালার ঘর। বর্ষায় জল পড়ে। একই ঘরে গরু ও মানুষের বাস। তারই মধ্যে স্বপ্ন দেখতে-দেখতে ঠাকুরদা হাইস্কুলের হেডমাস্টার হলেন। ছাতাটা তখনও ছিল। একটা ছাতা কত কী দেখল! দেশভাগ, উত্তম-সুচিত্রার ‘হারানো সুর”, ইস্টবেঙ্গলের টানা ছ’বার লিগ জয়, উত্তাল সত্তরের কত যুবকের অকালমৃত্যু—কাঠের ছাতা সব জানে।

বাঙালপাড়ার দুঃখ ছিল অনেক। তবে তেজ ছিল যথেষ্ট। আমার পাশের বাড়ির এক দাদু উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠ বের করে বিড়ি ধরাতেন। অতটা আগুন দিয়ে ওইটুকু বিড়ি ধরানোর মধ্যে স্পর্ধা ছিল প্রচুর। এই গনগনে তেজ ও স্পর্ধা ছিল বলেই বাঙালরা হেরে যায়নি কোনওদিন। যেদিন ইস্টবেঙ্গল জিতত আর যেদিন উত্তম-সুচিত্রার ছবি মুক্তি পেত বাঙালপাড়ায় সেদিন খুশির ঢেউ। ভিটেমাটি ছেড়ে আসার যন্ত্রণা যেন ভুলিয়ে দিত বাঙাল সুচিত্রা আর ঘটি উত্তমের চাঁদপানা মুখ। মুখে পান ঠুসে বাঙাল গিন্নিদের সিনেমা হলে যাওয়ার দৃশ্য ছিল দেখার মতো।
আমাদের পাড়ায় ছাতা সারাই করতে আসতেন বাংলাদেশের কিছু গরিব মানুষ। তাঁদের পাসপোর্ট-ভিসা ছিল কি না, জানি না। কিন্তু দিনের পর দিন তাঁরা ছাতা সারাই করতেন এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। মিষ্টি সুরে হাঁক দিতেন, ছা…তা…সা… রা…ই। আমার ঠাকুরদা তাঁদের কাছে সেই ছাতা সারাই করতেন। কখনও শিক সোজা করতেন, কখনও ছাতার গায়ে নতুন কাপড় দিয়ে পট্টি লাগাতেন। আসলে ছাতা নয়, ফেলে আসা রোদ-বৃষ্টিকেই যেন নতুন করে গায়ে মাখতেন বৃদ্ধ। আলাদা দেশ। তবু আলাদা কি? না হলে তিনি আমার কাছে বারবার শুনতে চাইবেন কেন, ‘আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি/সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ/ তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি/তাহার গানে আমার নাচে বুক…।
আলাদা দেশ নয়। আমরা আসলে একটি গাঁয়েই থাকি। আর কেউ না জানুক, কাঠের ছাতা সব জানে।

0
0

Leave a Comment