ঝকঝকে ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল । কোথাও সুন্দরী শিরোপার ছবি , কোথাও জিমে শারীরিক কসরতের ছবি , কোথাও আবার নাচের ভিডিও । হ্যাঁ, ঝকঝকেই বটে ! সাইনি সরকার । পুরোদস্তুর পরিচিত নাম ফ্যাশন , মডেলিং বা গ্ল্যামার জগতে । কলকাতায় তো বটেই , কাজের সুবাদে আরব সাগরের মায়া নগরীতেও ! ছুটতে হয় এদিক সেদিক, যাকে আমরা বলি হিল্লি , দিল্লি, মুম্বাই । এই দুনিয়ায় পায়ের কদম পোক্ত বলেই হয়তো এখন নিজে গ্রুমিং করেন , কলকাতার কালিকাপুর থেকে নিজের ইনস্টিটিউট এখন নিয়ে গেছেন বাঙ্গুরে । সাইনি সরকার , ২০২১ এর মিসেস ইন্ডিয়ার প্রথম রানার আপ। ২০২০ তে মিসেস কলকাতা প্রথম রানার আপ , আর সেই বছরেই মিসেস ওয়েস্ট বেঙ্গল দ্বিতীয় রানার আপ।
পরিচয় পর্ব টা তো হলো । এবারে সোজা ফ্ল্যাশব্যাকে ! ১৯৮৯ এর ডিসেম্বর, কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগ । কোন ঘেঁষা একটা বেড , সন্তানসম্ভবা এক মহিলার খাবার এসেছে । ডিম , দূধ , কলা , যেমনটা সরকারি হাসপাতালে হবু মায়েদের জন্য বরাদ্দ করা থাকে আর কী ! কিন্তু এবারের দৃশ্য টা আর পাঁচটা সাদা কালো ছবির মতো নয় , বরং আরও ধূসর ! সন্তানসম্ভবা ওই মহিলা খাবার টা ভাগ করে নিচ্ছেন তার স্বামীর সঙ্গে ! বিলক্ষণ জানেন যে সেটা ভাগ করে না নিলে তার স্বামীর এটুকুও জুটবে না ! খালি পেটে ওরকম ঝক্কির কাজ করা যায় নাকি ! এটুকু উপলব্ধি ওই হবু মায়ের অবশ্যই জানা । স্বামীর বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ , দিনে হোক বা রাতে ওরকম পরিশ্রমের শেষে মাস গেলে প্রাপ্য টাকা টুকু পেতে অনেক মাসে চপ্পলের সেলাই ছিঁড়ে যায় । মহিলা নিজে সেলাই এর কাজ করেন, পেটে কিছুটা বিদ্যা থাকার ফলে নিরক্ষরতা দূরীকরণে পড়ানোর কাজ টাও জুটে গেছে । এহেন পরিবারে এমন দৃশ্য তো ষোলোআনা বাস্তব চিত্র ! পরিচয় করিয়ে দেওয়া টা এবার জরুরি , এরা সাইনির মা বাবা । গর্ভে তখন সাইনি। সাইনি সরকারের ভূমিষ্ঠ হবার বাতাবরণ এটাই । চূড়ান্ত বৈপরীত্য লাগছে ? কিন্তু এটাই ষোলোআনার উপর আঠারো আনা সত্যি !
এহেন পরিবারে মেয়ের পড়াশুনো , বলা ভালো ন্যুনতম পুষ্টির যোগান হবে কী করে তা অনেক আগেই বুঝেছিলেন সাইনির মা । অতএব , সাইনি জন্মানোর ছ ‘ মাসের মাথায় ওর ঠিকানা হলো বেলঘরিয়ায় মামাবাড়িতে। হ্যাঁ, পলতা স্টেশন থেকে আধা ঘন্টার পিচ ওঠা পথের ধারের বিদ্যুৎ সংযোগহীন এক চিলতে ঘর নয়, সোজা বেলঘরিয়ায়। সেখানেই শুরু সাইনির পড়াশোনা । মহাকালী গার্লস হাই স্কুল। আদ্যোপান্ত বাংলা মিডিয়াম। তাই , কলেজ প্রথম বর্ষের পড়া চলাকালীন এয়ার হোস্টেস ট্রেনিং নিয়ে যেদিন এই মেয়ে জেটএয়ার এর বিমান সেবিকার কাজ পেয়েছিল সেদিন নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করেছিল সাইনির । আরও অনেক কিছু মাথায় এসেছিল ওর । জন্মের পর ওই এক চিলতে ঘরে যখন ও নিজে হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করলো তখনও সাইনি বোঝেনি ঘরের একমাত্র আলোটা জ্বলতো হুকিং করে ! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন , ওদের ঘরে তখন বিদ্যুৎ ছিল না ! মানে মাসের শেষে মিটার রিডিং করে পয়সা গোনার সামর্থ ওদের ছিল না। সাইনির পর ওর যখন একটা ভাই এলো তখনও চিত্রটা যে আকাশ পাতাল বদলেছে , এমনটাও নয় । মায়ের উদয়াস্ত পরিশ্রম ( ততদিনে উনি অঙ্গনওয়ারি স্কুলে পড়ান ) পার্থক্য একটাই , সরকারিভাবে বিদ্যুতের মিটার বসেছে , একটা পাখাও ঘরের মাথায় ঘোরে। এবার চোখের কোণে জল সামলাতে পারেনা সাইনি , ওর কথায় , ” মা সেদিন আমার আর ভাই এর কথা ভেবে পাখাটা আমাদের ঘরেই ভাই বোনের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন , ওটুকু হাওয়া যাতে আমরা পেতে পারি ! ২০১১ তে যেদিন জানলাম মায়ের ক্যান্সার , সেদিন কুড়ে কুড়ে খেত মনটা। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, এর ওর থেকে সাহায্য , মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি তহবিল থেকে অর্থ সব কিছু নিয়েই মুম্বই এর হাসপাতাল , ছোটাছুটি কম করিনি …. পরিণতি ২০১৮ তে মায়ের মৃত্যু ” এবার কার্যত কেঁদেই ফেলে মিস ইন্ডিয়ার রানার্স।
সাইনি র জীবনটায় সেলুলয়েডের জাম্প কাট, ফ্ল্যাশ ব্যাক, স্পেশাল এফেক্টের ছোঁয়া সবই আছে।
২০১১ তে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি , তার পরের বছরই কর্মজগতে প্রবেশ , সাফ মনে আছে সাইনির, পাঁচটা টাকা বাঁচানোর জন্য বালিগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেই রুবি হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত হেঁটে অফিস। সেখানেই প্রথম পরিচয় ও পরিশেষে পরিণয় স্বামীর সঙ্গে। সেটা ২০১৬ সাল , এখন ওদের সংসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ওদের ছ ‘ বছরের ছেলে ।
পরের অংশটা পুরোপুরি রূপকথার মতোই । সাইনি র অন্তত এমনটাই উপলব্ধি । আর হবে নাই বা কেন ! পরের চাকরিতে কার্যত ‘ বস ‘ দের উৎসাহে , বলা বাহুল্য ঠেলেঠুলে সাইনি কে একটা ছোটখাটো সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাঠানো , গল্পকথার মতোই শোনায় যে ! হ্যাঁ, এবার সাইনির সাদাকালো জীবনরেখায় রঙের ছিটে লাগে । প্রথম প্রতিযোগিতাতেই বাজিমাত। উৎসাহদাতার অভাব হয়নি সাইনির অফিসে। মোড় ঘোরা শুরু সেই থেকেই , ২০১৯ এ মুম্বই তে মডেলিং এর ডিপ্লোমা বাকি অংশ টা গোড়াতেই জেনে নিয়েছেন। অবশেষে রুপোলি রেখার ঝলক এই তন্বীর। একটা তথ্য না জানলেই নয়, যেদিন সাইনির ওই প্রথম প্রতিযোগিতায় জেতা , সেদিন ওর ওজন ছিল ৮৩ কেজি ! ছবিতে ওর চেহারার সঙ্গে মিলছে না? মিলবে কী করে ! জিমে বিস্তর কসরত , মায় ওর চেয়ে অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গেও সমান তালে টক্কর ! ওরাও তাজ্জব ! কিন্তু কম ঘাম ঝরাতে হয়নি সাইনির ! তবে ওর জীবনের লেখচিত্র যা, তার তুলনায় এ আর এমন কী ! শিরোনাম তো লেখাই হয়ে গেছে ওর জীবনের ! সাইনি রুপেন সংস্থিতা ।