তপন মল্লিক চৌধুরী
একদিন মিস শেফালির আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আরতি দাস। তখন তাঁকে বলা হতো ‘কুইন অব ক্যাবারে’। মিস শেফালি তখন কলকাতা মাতিয়ে রাখতেন। সময়টা গত শতকের সাতের দশক। শহরের বুকে সন্ধে নামলে ফিসফিসিয়ে উচ্চারিত হত একটাই নাম- মিস শেফালি। আসলে তিনি আরতি দাস, জন্মেছিলেন বাংলাদেশে। তারপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মাত্র ১২ বছর বয়সে চলে আসেন কলকাতায়।
পথ চলা শুরু আহিরীটোলার এক ছোট পরিবার থেকে। পরিবারকে তখন গ্রাস করছে দারিদ্র। চোখের জল বাধ মানতে নারাজ বাবার। ছোট্ট মেয়ে আরতি দরজায় দাঁড়িয়ে তখন কাজের প্রার্থী। পথচলা প্রায় সব মানুষের কাছে পৌঁছে আবেদন- একটা কাজ হবে। বয়স তখন দশ। কে দেবে ওইটুকু মেয়েকে কাজ! সুযোগ আসে এক বিদেশী পরিবারে পরিচারিকার কাজের। সেখানে সময় কাটত ভালোই। কলকাতার বুকে তখনও বিদেশীদের দাপট ছিল। রাতের শহরে এক ভিন্ন মেজাজ। সেই পরিবারেও তার আঁচ ছিল যথেষ্ট। সন্ধ্যে হলেই বসত আসর। সেখান থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে চলত নাচের পাঠ।
সেই পরিবারেই একদিন এক ব্যক্তির কাছে অনত্র চাকরির কথা জানান আরতি, পাল্টা প্রশ্ন আসে, তুমি নাচতে পারো! আরতি কিছু না বুঝেই সন্মতি জানিয়েছিলেন। এরপরই তাঁর ঠাঁই হয় গ্র্যান্ডে। প্রথম নাচেই বাজি মাত। বাড়তে থাকে কদর, সকলেই তাঁকে নেওয়ার দাবি করে। অবশেষে নাম পাল্টে হয় মিস শেফালি, আর পারিশ্রমিক, তখনকার দিনে ৭০০ টাকা। তখন থেকেই রাতের রানি হয়ে ওঠেন মিস শেফালি, অগোচরে রয়ে যায় আরতি দাস পরিচয়।
গ্র্যান্ড থেকে ফিরপোজ। সেখানকার দুই সাহেব মিস্টার ভ্যালে আর মিস্টার ডেভিড তাকে ডাকতেন ‘লিট্ল ফ্লাওয়ার’ নামে। ওই ‘লিট্ল ফ্লাওয়ার’ থেকে ওখানকার বাঙালি কর্তারা তাঁর নাম করে দেন শেফালি। মিস শেফালি। সেই থেকে আরতি নামে তাঁকে আর কেউ চেনে না, শুধু কাছের লোকেরা ছাড়া। তবে মিস শেফালি বেশি দিন ফিরপো’জ হোটেলে থাকেননি। হোটেলটাই তো পরে উঠে গেল। চলে যান গ্র্যানন্ড হোটেলে।
তরুণকুমার তাঁকে নিয়ে যান বিশ্বরূপায়। রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় ‘চৌরঙ্গী’তে অভিনয় করেন। তখন ওই নাটকে বিকাশ রায়, দিলীপ রায়, সত্য ব্যানার্জি, আরতি ভট্টাচার্যও অভিনয় করতেন। তারপর সারকারিনায় ‘সম্রাট ও সুন্দরী’। শেখর চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ বাইজি চূনীদাসীর চরিত্র। সেই নাটকে নায়িকা ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। সেই শুরু। তারপর বিস্মিত করেছেন দেশি এবং বিদেশি সাহেবদের।
অভিনয়ের জন্য ডাক আসে সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে। একবার নয় দুটি ছবিতে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’। ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে তিনি তা-ই করেছেন, যা সবচেয়ে ভালো পারেন, নাচ। সেই নাচের শুটিং হয়েছিল ফিরপো হোটেলের লিডো রুমে। আরতি বা মিস শেফালি নিজেই সব ব্যবস্থা করেছিলেন। মহানায়ক উত্তম কুমার পর্যন্ত তাঁর বেলি ড্যান্স আর হুলা মুভসে ধরাশায়ী হয়েছিলেন। প্রায় সন্ধ্যে বেলায় উত্তমকুমার তার শুটিং প্যাক আপের পর হাজির হতেন ফিরপো হোটেলের লিডো রুমে। একটি জায়গায় বিশেষ এক ধরনের ডান্স ফর্মের জন্য ডান্স করতে করতে একজনের গলায় মালা পরানোর সুযোগ আসে মিস শেফালির কাছে। সেই মানুষটি ছিলেন উত্তম কুমার। হুলা ডান্সে উত্তম কুমারকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে নাচিয়ে ছেড়েছিলেন মিস শেফালি। মনে মনে বলেছিলেন, ‘তুমি উত্তম কুমার হতে পার, আমিও মিস শেফালি, তোমাকে আজ ছাড়ছি না’। পরবর্তীকালে উত্তম কুমারের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাঁর।
বিয়ে করেননি শেফালি। শুধু মন দিয়ে, নিজেকে উজাড় করে নেচেছেন। পরিবারের সবার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। ভাইয়ের ছেলেকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। বাড়িতে যে মেয়েটি তাঁর কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন, সেই দুর্গাকে নিজের বোন বলে মনে করতেন।
মিস শেফালির জীবনের ওপর ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করবেন বলে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন কঙ্কনা সেন শর্মা। ২০১৭ সালে ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। সমালোচকদের দারুণ সমাদর পায় ছবিটি। এরপর আরতি দাসের ওপর ছবি নির্মাণ শুরু করেছিলেন পেশায় অঙ্কের অধ্যাপক জয়দীপ চক্রবর্তী। সেই ছবির নাম—‘ভোরের কুয়াশা’।